রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০০ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

তথ্যপ্রবাহে মুক্ত সাংবাদিকতা

জাকির হোসেন:
অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে এখন কোনো তথ্যই গোপন রাখা যায় না। কোনো না কোনো মাধ্যমে তা প্রকাশ পেয়ে যায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দেশে গণমাধ্যমের বিস্তৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সংবাদ পাওয়া এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। এখন সকালের খবর জানতে সন্ধ্যা বা পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে তা পৌঁছে যায় সবার কাছে। খবর দ্রুত প্রচার হওয়া ভালো, কিন্তু রিউমার যখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তা হয়ে যায় বিপজ্জনক। রিউমার দ্রুত ছড়িয়ে পড়া মানে হচ্ছে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করা। কথা হচ্ছে খবর তো দ্রুতই পেয়ে যাচ্ছি আমরা, কিন্তু মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমরা কেন পিছিয়ে পড়ছি?

সম্প্রতি বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবনমনের তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। এতে বলা হয়েছে বিশশ্ব গণমাধ্যম সূচকে বিশে^র ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম, গেল বছর ছিল ১৬৩। কারণ হিসেবে সংস্থাটি যেসব তথ্য দিয়েছে তার মধ্যে রাজনৈতিক খবরদারি ও করপোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকতায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। এছাড়া সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট মুক্ত সাংবাদিকতার প্রধান বাধা। ফলে সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন হচ্ছে না এবং সাংবাদিকরা সঠিক সাংবাদিকতা করতে পারছেন না বলে মত সংস্থাটির। পাশাপাশি অপসাংবাদিকতার বিকাশ ঘটছে। সাংবাদিকের এবং সাংবাদিকতার মর্যাদা ক্ষুন্ন করছে।

আমাদের দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা কত? সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ৩ হাজার ২১০টি (অনলাইন গণমাধ্যম ছাড়া) যার মধ্যে ১ হাজার ৩৫৭টি ঢাকা থেকে এবং ১ হাজার ৮৫৩টি অন্যান্য জেলা থেকে প্রকাশিত হয়। তবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ৫৮৪টি। এর মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ২৮২টি পত্রিকা। আর ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২০৮টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ১৬৮টি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন নিউজ পোর্টালকে নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধনের আবেদন করা ও এর বাইরে আছে আরও প্রায় হাজার খানেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এর বাইরে টেলিভিশন চ্যানেল এবং টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন চালু আছে। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকা এখনো কিছু প্রকাশিত হয়। তাহলে সব মিলিয়ে বলা যায় দেশে প্রায় ৪ হাজার গণমাধ্যম একসঙ্গে চালু আছে এবং সংবাদ পরিবেশন করছে। এর বাইরে এ সময়ে আরেকটি মাধ্যম সংবাদ এবং রিউমার প্রচার করে, তা হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউব বেশি জনপ্রিয় সাধারণ মানুষের কাছে। ইউটিউবে আবার টিভি চ্যানেল নামেও প্যাকেজ সংবাদ প্রচার করে। এ থেকে বুঝা যায় তথ্যপ্রবাহে কোনো ঘাটতির সুযোগ নেই। প্রশ্ন হলো এই তথ্যপ্রবাহে মুক্ত সাংবাদিকতা কীভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

একসময় সংবাদ পরিবেশনে একজন সাংবাদিককে বেশ পরিশ্রম করতে হতো। সময় মতো অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করা, সেগুলো লেখা এবং সময় মতো অফিসে জমা দেওয়া ছিল রীতিমতো যুদ্ধের মতো। এটা ৯০-এর দশকের চিত্র। ওই সময় পত্রিকার খবরের জন্য পাঠকদের দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। সকালের প্রকাশিত আগের দিনের খবর ঝড় তুলত। সাংবাদিকদের মর্যাদাও ছিল অন্যরকম। এ সবই পাল্টে যায় বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে মোবাইল ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার মধ্য দিয়ে। এখন আর সংবাদের জন্য পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয় না পাঠকদের। দিনের খবর মুহূর্তের মধ্যে চলে আসে পাঠকের কাছে। ৯০-এর দশক পর্যন্ত দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা ছিল খুবই কম। এ কারণে হয়তো পাঠকের কাছে খবরের গুরুত্বও ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে আমাদের দেশে গণমাধ্যমের শুধু বিকাশই না, রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটেছে। মিডিয়া হয়ে যায় রাজনীতিকদের হাতিয়ার এবং ব্যবসায়ীদের পণ্যের মতো। প্রথমত রাজনীতিকরা নিজেদের অনিয়ম, দুর্নীতি ঢাকতে ও প্রচার চালাতে মিডিয়াকে ব্যবহার করছেন। আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকতাকে তার ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। করপোরেটের হাতে গণমাধ্যম চলে যাওয়ায় সাংবাদিকদের আর্থিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে ঠিকই। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রটি অনেকাংশে রুদ্ধ করে দিয়েছে। এ সময়ে দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের মালিকানা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অধীনে। যারা খবরকে ম্যানুপুলেট করে, প্রভাবিত করে, কখনো পরিবর্তন করে। বলা যায় করপোরেটরা মিডিয়া হাউজ খুলে সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

মূলত সাংবাদিকতা পেশার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি হয়নি বলে করপোরেটরা সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিয়েছে। আমাদের প্রেস ইনস্টিটিউট, প্রেস ক্লাব বা অন্যান্য সংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভাজন, সাংবাদিকতার নীতি বিবর্জিত হয়ে রাজনৈতিক বলয়ে চলে যাওয়ার কারণেই নিয়ম নীতিহীন ভাবেই করপোরেটরা সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও আমাদের এ সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা আছে। কিন্তু সেগুলো মানা হচ্ছে না। এই যে মানা হচ্ছে না তা বলারও যেন কেউ নেই। একটি সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রেস কাউন্সিলের অ্যাক্ট আছে, নীতিমালা আছে। একটি পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার জন্যও কিছু নিয়ম আছে। কিন্তু এসব নিয়ম কি মানা হচ্ছে? এখন একজন ব্যবসায়ী পত্রিকা বা গণমাধ্যমের অনুমোদন চেয়ে পেয়ে যান খুব সহজেই। হয়ে যাচ্ছেন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। যদিও সাংবাদিকতার সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু সরকার তাদের মিডিয়া পরিচালনার অনুমোদন দিচ্ছে। সাংবাদিকরাও সুযোগ-সুবিধার আশায় তাদের দারস্থ হচ্ছেন।

সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করছে অনুমোদনহীন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেলগুলো। একটি সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল বাজারে আনতে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হয়। যেটা বড় ব্যবসায়ী বা পয়সাওয়ালা ছাড়া সম্ভব হয় না। সেখানে অনলাইন নিউজ পোর্টাল অনএয়ার করতে খরচ অতি নগণ্য। যে কারণে যে যার মতো করে অনলাইন পোর্টাল নিয়ে আসছে। বাজারে এনে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য আবেদন করে সংবাদ পরিবেশন করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব অনলাইন পোর্টালগুলোর পেছনে থাকে রাজনৈতিক পরিচয়। অর্থাৎ সরকারি দপ্তরে জানাশোনা থাকলেই চলে। এখন পর্যন্ত অনুমোদিত নিউজ পোর্টালের তালিকা দেখে বিস্মিত হতেই হয়। এর অনেকগুলোই চলে নামকাওয়াস্তে। অফিস আদৌ আছে কিনা জানি না। কোনো পাঠক তাদের অনলাইনে সংবাদ জানতে ঢুকে কি না সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কীভাবে এসব পোর্টাল অনুমোদন পেল? তাদের নিউজ পোর্টাল করার উদ্দেশ্য কী? খোঁজ করলে হয়তো পাওয়া যাবে এগুলো কোনোটি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বা কোনোটি ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এদের লক্ষ্য থাকে মূলত দুই প্রকার। এক, সরকারের গুণগান প্রচার করে সুবিধা আদায়; দুই, গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে কাউকে হেনস্তা করা। কেননা একটি খবর প্রকাশ পাওয়ার পর তা যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয় তা যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থাকে না।

ইদানীং প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের বহর দেখে অবাক হতে হয়। কারণ, এমন সব গণমাধ্যমের ব্যানারে তারা এসেছেন যাদের মূলধারার সাংবাদিকরা চেনেনই না। শোনা যায় এরা প্রেস ক্লাবের হলরুমে কোনো প্রতিষ্ঠানের সংবাদ সম্মেলন বা কনফারেন্স প্রচার করার নামে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। যা মূলধারার সাংবাদিকদের লজ্জিত করে এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদি সাংবাদিকদের বড় সংগঠন প্রেস ক্লাব চত্বরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে তা হলে সাংবাদিকদের মর্যাদা রক্ষা করবে কে? রাজধানীর বাইরের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। শোনা যায়, অনিবন্ধিত বা রাজনৈতিক পরিচয়ে নিবন্ধিত গণমাধ্যমের কর্মীরা সরকারি দপ্তরে বসে থাকেন অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য। আমরা জানি বেশিরভাগ সরকারি দপ্তরে নানা ধরনের অনিয়ম ঘটে। কিছু নীতিবিবর্জিত সরকারি কর্মকর্তা নানা অনিয়মের আশ্রয় নেন। সে কারণে ওই কর্মকর্তারা এসব সাংবাদিকদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এতে মূলধারার সাংবাদিকরা যখন তথ্য সংগ্রহে সরকারি দপ্তরে যান তখন তাকে সরকারি কর্মকর্তার রোষে পড়তে হয়। সম্প্রতি শেরপুরে নকলায় দেশ রূপান্তরের এক সাংবাদিক তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে কর্মকর্তার রোষে পড়েছিলেন। এছাড়াও অসংখ্য সাংবাদিক নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের রোষে পড়েছেন। রাজনীতিকরাও চাচ্ছেন সাংবাদিকদের অবাধ তথ্য চাওয়ার অধিকার বন্ধ করতে। এ কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সচিবালয়ে সাংবাদিকদের চলাচল নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে, দুদকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। অন্য সরকারি দপ্তরগুলোতেও তাই হচ্ছে। এসব কারণে মূলধারার সাংবাদিকরা পিছিয়ে পড়ছেন বস্তুনিষ্ঠ খবর সংগ্রহে। যা বিদেশি সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য যাচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকায় বাংলাদেশ সরকার বাধা দিচ্ছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার এটাও একটা কারণ।

সুষ্ঠু ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য অপসাংবাদিকতা বন্ধ করতে পারে আমাদের সাংবাদিক সংগঠনগুলো। প্রেস ক্লাবকে এক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। এখনো প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ পেতে মূলধারার সাংবাদিকদের কাঠখড় পোড়াতে হয়, আর এমন অনেকেই সদস্যপদ পেয়েছেন যারা কখনোই মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে ছিলেন না। গত বছর পাবনার এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মো. নিজামুল হক নাসিম বলেছিলেন, সাংবাদিকতার নীতিমালা হচ্ছে। সাংবাদিকদের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা হবে স্নাতক। ওই বছরই পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিকদের তথ্যভান্ডার তৈরি হচ্ছে। তথ্যভান্ডার তৈরির পর যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত সাংবাদিকদের সনদ দেবে প্রেস কাউন্সিল। সনদধারীরাই কেবল নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিতে পারবেন। খুবই ভালো কথা। সাংবাদিকতার জন্য শিক্ষা জরুরি। এতে অন্তত যে কেউ নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিতে পারবেন না। প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের সনদ দিতেই পারে। কিন্তু তা যদি হয় অনলাইন নিউজ পোর্টালের অনুমোদন দেওয়ার মতো, তবে ওই সনদ দরকার নেই। ওই সনদ দিয়ে অপসাংবাদিকতাকেই পাকাপোক্ত করা হবে মাত্র।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক

zakpol74@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION